Advertisement

Main Ad

আফ্রিকান লাংফিশ

মাছের নাম বললেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে পানিতে বসবাসকারী একটি প্রাণির নাম,যা পানিতে সাঁতরিয়ে চলে। পানির বাইরে যার বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠে। বর্তমানে পৃথিবীতে মাছের মধ্যে ব্যাপক বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায় । পৃথিবীতে আনুমানিক ৪২০০০ প্রজাতির মাছ রয়েছে এবং সেই সংখ্যাটা দিনদিন বেড়েই চলছে।কিছু কিছু প্রজাতির মাছ আমাদেরকে রোমাঞ্চিত করে, আবার কিছু কিছু মাছ আমাদের ভয় পাওয়ার কারণ হয়েও দাড়ায় ।উড়ুক্কু মাছ অথবা বিদ্যুৎ উৎপন্নকারী মাছের নাম আমরা প্রায় সময়ই শুনে থাকি। এবার একটা পরিস্থিতির কথা কল্পনা করুন। প্রচন্ড গরম চারদিকে। জলাধার, যেখানে একসময় পানি ছিল কিন্তুু এখন ফেটে চৌচির হয়ে আছে। পানির দেখা নেই ৩/৪ বছর ধরে। কিন্তুু একদল গবেষক তারা এসেছেন সেই চৌচির হওয়া মাটি খুড়ে মাছ ধরতে। বিষয়টাকে হাস্যকর বললেও ভুল হবে। তারা কি আদৌ মাছ ধরতেই এসেছেন নাকি মাঠি খুড়ে সাপ ধরতে এসেছে প্রশ্ন থেকেই যায়। গবেষকরা নাচোড়বান্দা, তাদের কাছে তথ্য আছে মাটি খুড়লে মাছ পাওয়া যাবে। তারা মাটি খুড়তে শুরু করল। মাটি খুড়তেই থাকল, খুড়তেই থাকল। হঠাৎ তারা মাটির নিচে গুটির মত কিছু একটা পেল, যেন পলিথিনে মোড়ানো কোনো বিশেষ গুপ্তধন। উপরের খোলসটা খোলার সাথে সাথেই দেখা মিলল ১৫/১৬ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের জীবন্ত নড়াচড়া করছে এমন একটা মাছের।যারা প্রথমবার এমন অভিজ্ঞতার মধ্যে পড়েছে তারা সত্যিই ভয় পেয়েছে হয়ত । এভাবে তারা মাটি খুড়ে বেশ কয়েকটি মাছ ধরল। এটা কোনো রূপকথার গল্প মনে হলেও বাস্তবে এটা কোনো মিথ্যে গল্প নয়। সত্যি সত্যিই এমন মাছও আমাদের বৈচিত্র্যময় পৃথিবীতে আছে ।এবার আসল কথায় আসি।

আমরা জানি যে,বৈচিত্র্যময় পৃথিবীতে প্রাণিদেরও বৈচিত্রের শেষ নেই। আর আফ্রিকার নাম নিলে তো বৈচিত্র্যময় প্রাণিদের দ্বার উন্মোচন হয় । পশ্চিম আফ্রিকায় এ ধরনের মাছের দেখা মিলে। এবং মাছটি আফ্রিকান লাংফিশ(African lungfish)নামেই পরিচিত। আফ্রিকার লাংফিশের কিছু চটুল অভিযোজন ক্ষমতা রয়েছে।এদের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য এরা দীর্ঘদিন হাইবারনেশনে যেতে পারে।হাইবারনেশন হল শীতনিদ্রায় যাওয়া।এটি প্রানিদের একটি বিশেষ অভিযোজন ক্ষমতা। যেমন শীতকালে সাপ যেমন গর্তে ঘুমিয়ে কাটায়, তাছাড়া অজগড় সাপ যেমন বছরের বেশিরভাগ সময় ঘুমিয়ে কাটায়। এতে তারা একবার খাদ্য খেয়ে শক্তি সংরক্ষনের মাধ্যমে অনেকদিন ঘুমিয়ে পার করে দেয়। আফ্রিকান লাংফিশের দুটি ফুসফুস রয়েছে। এরা অন্যন্যা মাছের থেকে কিছু স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়ে থাকে। এরা পরিণত বয়সে পশু পাখি এবং অন্যান্য স্থলজ প্রাণীদের মত বায়ুতে শ্বাস নেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করে। এরা সাধারণত প্রায়ই শুকিয়ে যায় এমন বন্যার সমভূমিতে বাস করে বলে এটি এদের একটি অত্যাবশ্যক বৈশিষ্ট্য। এরকম প্রতিকূল পরিবেশে ঠিকে থাকতে এরা শরীর থেকে তরল জাতীয় এক ধরণের একটি পাতলা স্তর নির্গত করে যা শুকিয়ে একটি গুটির মত হয়ে যায় । এটি বছরের পর বছর পর্যন্ত এই গুটি হতে পানি গ্রহন করে বেঁচে থাকতে পারে। আফ্রিকান লাংফিস পানিতেও হাইবারনেশনে যেতে পারে ।এগুলো শুকনো মৌসুমে কাদা-মাটিতে গর্তের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে, এবং তারা তাদের দীর্ঘ উপাঙ্গ ব্যবহার করে জলের বাইরে বেরিয়ে যেতে পারে। সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বায়োলজিক্যাল সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর এবং প্রধান গবেষক ইউয়েন নং এই মাছটির ওপর গবেষণা পরিচালিত করেন। সাসপেন্ডেন্ট অ্যানিমেশন অবস্থার ৬ মাস পর মিঠাপানিতে নিয়ে এ মাছের লিভারের জেনেটিক অবস্থা পরীক্ষা করা হয়। টানা ছয় মাস পর অসাড় অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার পরদিনও পরীক্ষা করা হয়। বিজ্ঞানী দেখেছেন, তাপমাত্রার খুব বেশি বৃদ্ধি বা হ্রাসে এ মাছের দেহের কোষের কার্যক্রমে পরিবর্তন আসে। এমন অনুর্বর ও চরমভাবপন্ন পরিবেশে আফ্রিকান লাংফিশগুলো অসাড় অবস্থায় চলে যায়। এ পরিস্থিতিতে কিছুই না খেয়ে এবং বর্জ্যের উৎপাদন বন্ধ করে তারা দিব্যি বহুকাল টিকে থাকতে পারে। এই নির্দিষ্ট সময়ে প্রাণশক্তি জমিয়ে রাখার বিষয়টিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আবার এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার পর পুনরায় আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার জৈবিক প্রক্রিয়াটিও বিস্ময়কর।

এরা যখন প্রতিকূল পরিবেশের আন্দাজ করে বা পানি শুকিয়ে যাচ্ছে এমন পরিস্থিতির সমুখীন হয় তখন এটি জলপথের ১-৯ ইঞ্চি নীচে মাটি খনন করে। তারপর দেহ দিয়ে আশেপাশের মাঠিকে আন্দোলিত করে একটি বাল্ব-আকৃতির চেম্বার তৈরি করে এবং উক্ত চেম্বারে লাংফিশ এর নাকের দিকটিকে ঊর্ধ্বমুখীভাবে অবস্থান নেয়।যখন পানি শুকিয়ে যায় তখন এরা মাটির নিচে এভাবেই অবস্থান করে এবং পুনরায় জলধারা না পাওয়া পর্যন্ত এভাবেই অবস্থান করে। এটি সম্ভবত সম্ভব কারণ তারা বাইরের বাতাস থেকে তাদের ফুসফুস পূরণ করতে পারে, তাদের শরীরের উষ্ণতা বৃদ্ধি করতে পারে। এমতাবস্থায় এদের বিপাকীয় হার ধীরে ধীরে খু্ব কমে যায় এবং বাঁচার জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্ঠি মাংসপেশির ভাঙ্গনের মাধ্যমে পেয়ে থাকে। এটি এই অবস্থায় ৫ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। আফ্রিকার লাংফিশ তাদের পেছনের পাতলা অঙ্গগুলিকে ব্যবহার করে প্রয়োজনের সময় নিজেদেরকে নীচ পৃষ্ঠ থেকে তুলে নিতে এবং নিজেদেরকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে লাংফিশ পশুদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত যেগুলি বিবর্তিত এবং পানি থেকে এসে ডাঙ্গায় উপর বেঁচে থাকে। আফ্রিকান লাংফিশের খাদ্য বৈচিত্রপূর্ণ। এগুলো ব্যাঙ,ছোট মাছ এবং মোলাস্কার পাশাপাশি গাছের শিকড় ও বীজও খাদ্যের তালিকায় রাখে। এগুলো ৭ ইঞ্চি থেকে ৪০ ইঞ্চি দীর্ঘের মধ্যে বেড়ে ওঠে এবং প্রায় ৮ পাউন্ড পর্যন্ত ওজনের হয়ে থাকে । আফ্রিকার লাংফিশকে দ্বৈতশ্বাস ফেলা মাছ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। অধিকাংশ অল্পবয়স্ক লাংফিশ গিলাকে ব্যবহার করে শ্বাস নেয় কিন্তু প্রাপ্ত বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই গিলগুলো সংখ্যা কম যায় ।এদের জীবনকালে , এরা ধীরে ধীরে জলে শ্বাস নেওয়া প্রাণি থেকে বায়ুতে শ্বাস নেওয়া প্রাণীতে অভিযোজিত হয়।এই মাছগুলি মাঝে মাঝে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় যেখানে পানিতে অক্সিজেনের ঘনত্ব একেবারে নেই বললেই চলে । কখনও কখনও এদের জলজ আবাস একদম শুকিয়ে যায়, যা এদের বেঁচে থাকার জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে যায়। এমতাবস্থায় এরা মাটির নিচে নিজেদের আত্নগোপন করে যতদিন না পর্যন্ত জলের সন্ধান না পায়।এদের বিশেষ কিছু অভিযোজন ক্ষমতাঃ

১)আফ্রিকান লাংফিশ কোন প্রকার খাদ্য গ্রহন ছাড়াই পাঁচ বছর পর্যন্ত হাইবারনেশনে যেতে পারে।

২)ধারণা করা হয় এই অবস্থায় লাঙফিশ তাদের জৈবিক ঘড়িকে ধীর পর্যায়ে নিয়ে যায়।

৩)দীর্ঘদিন এরা শক্তি সংরক্ষণের মাধ্যমে বেঁচে থাকতে পারে।

৪)লিভারের জীন অভিব্যক্তির তুলনা হয় হাইবারনেশনের সময় এবং এই প্রক্রিয়ার পরে।

৫) শুকনো মাটির নিচেও এদের বেঁচে থাকার তুমুল ক্ষমতা রয়েছে।



আফ্রিকান লাংফিশ তিন থেকে পাঁচ বছরের জন্য কোনও খাদ্য গ্রহন ছাড়াই ঘুমাতে পারে, কেবল জল পাওয়া গেলে এরা আবার জেগে উঠে। স্থগিত এই অ্যানিমেশনের সময়, এই মাছ খাবার গ্রহন অথবা পান করে না এবং কোন বর্জ্য উৎপন্ন করে না। এমনকি কখনও কখনও পাঁচ বছর পর্যন্ত।গবেষকরা দাবি করেন যে এই প্রক্রিয়ার মধ্যে তারা তাদের জৈবিক ঘড়িটি ধীর করে নেয় এবং খুব কম শক্তির মাধ্যমে খাদ্য সরবরাহ এবং বেঁচে থাকার স্বাভাবিক চাহিদা সম্পন্ন করে । লাংফিশের এই রহস্যময় অভিযোজন ক্ষমতা বিজ্ঞানীদের সবসময় আকৃষ্ট করেছে কারণ যদি এই মাছের কিছু জীন মানুষের দেহে প্রতিলিপন করা যায় তাহলে মানুষের জন্য এটা এক সুদূরপ্রসারী অধ্যায়ের সূচনা হবে। যদি এমনটা হয় তাহলে নিম্নোক্ত সুবিধাসমূহ মানুষ পেতে পারবে।

১)গুরুতর অবস্থার রোগীদের মধ্যে প্ররোচিত হতে পারে।যেমন বন্দুকের আঘাতের ক্ষত, মস্তিষ্ককে বন্ধ ব্যাতিরেখে কিছু অতিরিক্ত সময় কিনতে।

২)গবেষকরা বলছেন এর মাধ্যমে শক্তি সংরক্ষণের কৌশল হতে সৃষ্টি করা যেতে পারে।

৩) জরুরি অপারেশনে উক্ত প্রক্রিয়া কাজে লাগিয়ে রোগিকে বাঁচানোর পথ দেখানো যেতে পারে।।

৪)অভিযোজনের ফলে মাছটি খুব কম পদার্থ রেচন করে এবং শক্তি সংরক্ষণ করে তোলে।এই প্রক্রিয়া কাজে লাগিয়ে ডিএনএ প্রতিলিপনের মাধ্যমে মানুষ সহজেই মহাকাশে ভ্রমনে সময় কাটাতে পারবে।

৫)একটি গবেষণায় দেখায় যে, সেলুলার পর্যায়ে উক্ত মাছের মধ্যে কী ঘটেছে।এর দ্বারা বিজ্ঞানীরা একদিন মানুষের মধ্যে একই রকম অবস্থা তৈরি করতে পারে।এবং দীর্ঘ দূরত্বের স্থান ভ্রমণ ,এছাড়া সম্ভাব্য ওষুধের আরও উন্নতকরণ করতে পারবে।

Post a Comment

0 Comments