Advertisement

Main Ad

আই লাভ ইউ

দু ’ দিন আগের ঘটনা । আমাদের এক আত্মীয় যুবক আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল । দেখতে বেশ তাগড়া । তার দৈহিক গঠন ভালাে । সুস্বাস্থ্যবান । নৈতিক চরিত্রের দিক থেকেও পিছিয়ে নেই । বয়স ত্রিশের কোটা ছুইছুই । তবে বেচারা এখনও বিয়ে করেননি ।কথা প্রসঙ্গে তাকে জিজ্ঞেস করলাম , আরে ! তুমি বিয়ে করছ না কেন ? জবাবে সে যা বলল তাতে আমার টাসকি খাওয়ার মতাে অবস্থা । সে জানাল যে , বিয়ের ব্যাপারে আমি আমার পরিচিতজনের অনেকের সাথেই আলাপ করেছি । ব্যাপারটি নিয়ে পরিচিত ছেলে - মেয়ে , বন্ধু - বান্ধব যার সাথেই কথা বলেছি , তারা সবাই আমাকে বৈবাহিক জীবনে অশান্তি , কলহ , ঝগড়া বিবাদ , বউ - শাশুড়ির অমিল ইত্যাদির শত অভিযােগ শুনিয়েছে । শুধু তাই নয় , তারা নিজেদের সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে মতামত ব্যক্ত করেছে যে , বিয়ে না করাই ভালাে ছিল । আমি তাদের কথায় বুঝলাম যে , এ যুগে বিয়ে করার অর্থ মাথাব্যথা ও হৃদরােগ সৃষ্টি করা ছাড়া আর কিছুই না । অতএব আমি নিজের কষ্টার্জিত অর্থে মনােবেদনা ও জীবনযন্ত্রণা কিনতে চাই না । আমি আমার সেই আত্মীয় যুবককে বললাম , আরে ! তােমার যে বন্ধুদের কাছে জিজ্ঞেস করেছ , তারা অবশ্যই মানুষ হবে নিশ্চয় ? জবাবে সে বলল ,আরে ! মানুষ না হলে কি আর নিজেদের দাম্পত্যজীবনের কষ্টটা বুঝতে পেরেছে ? আমি তাকে বললাম , তারা কষ্ট ও ব্যথায় আছে বলে সবারই কি একই দশা হবে ? জবাবে আমার অত্নীয় কাচুমাচু করতে লাগল । আমি সুযােগ বুকে তাকে বললাম , আচ্ছা ! তুমি তাদের জিজ্ঞেস করলে, অথচ আমার কাছে জিজ্ঞেস করলে না কেন ? যে ব্যক্তি পাঁচ - দশটি মজলিসে হাজির হয়ে বৈবাহিক বিবাদ মীমাংসা করে , এ সম্পর্কে অবশ্যই তার জ্ঞান মন্দ হয়ার কথা নয় । তাই কাচারি এক জায়গায় রেখে অন্যত্র গিয়ে কান ডললে কি সমস্যার সমাধান হবে ? বরং এটাতাে অরণ্যে রােদন বৈ অন্য কিছু নয় । আমার কথায় আমার আত্মীয়ের আত্মসম্মানে হালকা আঘাত লাগল । ব্যাপারটি আমি আঁচও করলাম । আমি তাকে বললাম , শােন ! আমি কোর্টে ত্রিশ হাজারেরও অধিক দম্পতির সাস্যার সমাধান করেছি । সেখানে স্বামী - স্ত্রীর দ্বিপাক্ষিক কথাবার্তা শুনেছি । বহু লাভ মারেজ সমস্যার সমাধান করেছি । তাছাড়া আমি ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে বিভিন্ন সমস্যা নিরসনে নিয়ােজিত এক ব্যক্তি । একটা সময় এসব নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম । তখন লেখালেখিতে প্রবেশ করিনি । সে সময়ে বিধবাদের জন্যে প্রশিক্ষণশালা খুলেছিলাম । তাই আমার অভিজ্ঞতার ঝুলি একেবারে ঠুটো নয় । আশা করি আমার সম্পর্কে তােমারও তাে কম - বেশ জানা আছে । তা সত্ত্বেও তুমি আমার সাথে পরামর্শ করলে না কেন ? জবাবে ত্রিশের কোটায় করাঘাতকারী যুবক বলল , আচ্ছা ! আপনি কি দেখেন না , অধিকাংশ দম্পতির জীবনে সব সময় অশান্তি লেগে থাকে ? আমি তাকে বললাম যে , আমি তােমাকে প্রথমে দম্পতি - বিবাদের মূল রহস্য বােঝানাের চেষ্টা করব । বিবাদের কী অর্থ তাও বােঝা দরকার । স্বামী - স্ত্রীর পারস্পরিক মতানৈক্যকে বিবাদ বলা যাবে না । কারণ এটা সম্ভব নয় যে , জীবনের প্রতিটি দিন , প্রতিটি মুহূর্ত শুধু আনন্দ করবে। লাইলি - মজনুর মতাে প্রতিদিন প্রেমালাপ করাও সম্ভব নয় । তাহলে আর কি ! যুবক জানতে চাইল । জবাবে আমি বললাম , শােন ! ভালােবাসার মিলন মানেই কি কেবল সে । তােমাকে বলবে - ' আই লাভ ইউ ! ' তথা ‘ আমি তােমাকে ভালােবাসি ' ! আর তুমি তাকে বলবে - ' আই লাভ ইউ টু ! তথা তােমাকেও আমি ভালােবাসি ? এভাবে যখন একই শব্দ বারবার বিনিময় হতে থাকবে ? তখন তাে এ শব্দের আর কোনাে অর্থই থাকবে না । মনে রাখবে বর্তমান পৃথিবীর বহুল ব্যবহৃত শব্দ হলাে এই ‘ আই লাভ ইউ ' । কিন্তু ব্যবহারের আধিক্যে এটি এখন সবচেয়ে বেশি হওয়ায় এটি এখন মুখের বুলিতে পরিণত হয়েছে । এটি এখন কথার কথা । এখন যে শিশুটির মুখে কথা ফুটতে শুরু করে , সেও তার বড়দের মুখে শুনে ‘ আই লাভ ইউ ’ বলতে থাকে । আচ্ছা , দুই বছরের এই শিশুটি আই লাভ ইউ ’ র কী বােঝে ? মূলত ছােট বাচ্চারা এমনই ভাবে । যদি এই শব্দগুলাের মাঝেই লাইলি মজনুর দাম্পত্য সীমাবদ্ধ থাকত তাহলে বিয়ের দ্বিতীয় মাসের শুরুতেই তাদের বাদানুবাদ লেগে যেত । তৃতীয় মাসে পাড়া - প্রতিবেশী সবাই শুনতে পেত । আর বছরের শেষ প্রান্তে এসে শরয়ী আদালতে বিচ্ছিন্নতার দাবি উঠত । তাহলে জগতের কোথাও এমন শূন্যসার বৈবাহিক জীবন সম্ভবপর হতাে না । কেবল গল্প - উপন্যাসেই স্থান পেত । যুবকটি বুঝতে শুরু করল । সে বলল , ব্যাপারটি তাে এভাবে ভাবিনি ! আমি তাকে বলতে লাগলাম , স্বামী - স্ত্রী মাঝে - মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মতবিরােধ করতে পারে । একজন আলেমের পরিবারেও এ ধরনের বিবাদ হয়ে থাকে । এমনকি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘরেও এ জাতীয় মতভিন্নতা হতাে । অথচ তার পরিবার ছিল জগতের শ্রেষ্ঠ পরিবার ।যুবকটি যেন আমার কথাগুলােকে গােগ্রাসে গিলতে লাগল । আমিও সুযােগের সদ্ব্যবহার করতে কসুর করিনি । আমি তাকে বললাম , আমার কথা বিশ্বাস না হলে সূরা তাহরীম পড়ে দেখুন । সাহাবায়ে কিরাম ( রা . ) তাঁদের স্ত্রীদের বিরুদ্ধে নবীজীর দরবারে অভিযােগ দায়ের করতেন । ‘ ব্যাপারটি একটু খুলে বলুন তাে ! ' যুবক আব্দার জানাল । আমি উদাহরণ দিয়ে বললাম , এক ব্যক্তি হযরত ওমর ( রা ) - এর কাছে স্বীয় স্ত্রীর ব্যাপারে নালিশ নিয়ে হাজির হলেন । যখন তিনি দরজায় করাঘাত করলেন , তখন ঘরের ভেতর হযরত ওমরের স্ত্রীর উচ্চ আওয়াজ শুনতে পেলেন । আগন্তুক ব্যক্তি লক্ষ করলেন যে , হযরত ওমর নীরব আছেন । অথচ নেতৃস্থানীয় লােকেরা পর্যন্ত তাঁর নাম শুনে কেঁপে উঠত ! এরই মধ্যে লােকটি চলে যাচ্ছিল । হযরত ওমর ( রা ) ঘর হতে বেরিয়ে এলেন । তিনি তাকে ডাক দিলেন । লােকটি ফিরে এসে জানাল যে , আমীরুল মুমিনীন ! আমি আমার স্ত্রীর অসদাচরণের অভিযােগ করতে এসেছিলাম । কিন্তু এখন দেখি আপনিও আমার মতো ভক্তভােগী । জবাবে হযরত ওমর হেসে দিয়ে বললেন , এসব সহ্য করে নিতে হয় । কারণ আমার ওপর তারও অধিকার রয়েছে । মনে রাখবেন , আল্লাহ তায়ালা একই আকৃতি দিয়ে দুটি মানুষকে সৃষ্টি করেননি । এমনকি যমজদেরও না । কখনও কখনও তাদেরকে একই রকম । মনে হলেও তাদের মাঝে সূক্ষ্ম পার্থক্য বিদ্যমান থাকে । ঠিক তেমনি একই স্বভাব - চরিত্র দিয়েও মহান আল্লাহ কাউকে সৃষ্টি করেননি । কুরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে :- সূরা আল আহ্‌যাব (الْأحزاب), আয়াত: ৩৬ وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥٓ أَمْرًا أَن يَكُونَ لَهُمُ ٱلْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَن يَعْصِ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَٰلًا مُّبِينًا আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোনাে নির্দেশ দিলে কোনাে মুমিন পুরুষ ও নারীর জন্য নিজদের ব্যাপারে অন্য কিছু এখতিয়ার করার অধিকার থাকে না । আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করল সে স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে । যদি দু ’ জন বন্ধু , পার্টনার , শরিকদার , ব্যবসায়ী বা স্বামী - স্ত্রী চায় যে , তাদের মাঝে বিরােধ না হােক ; তাহলে একজনকে অবশ্যই অন্যের মত মেনে নিজের মতের বিরােধিতা করতে হবে । আপনি যদি রাস্তার ডান পাশে থাকেন আর আপনার বন্ধু থাকে বাম পাশে এবং দু ’ জনে মােসাফাহা করতে চান , তাহলে একজনকে রাস্তা পার হয়ে আসতে হবে । নতুবা হয় দু ’ জনই দু ' পাশ থেকে এগিয়ে এসে মাঝ রাস্তায় মিলতে হবে । মনে রাখবেন , প্রতিটি অংশীদারি কাজে একজন কর্তা থাকা জরুরি । বৈবাহিক জীবনে অবশ্যই কর্তা হবেন স্বামী । তাই যেকোনাে ব্যাপারে তার মতের অগ্রাধিকার থাকবে । ছােটখাট বিষয় হলে আলাদা কথা । অন্যদিকে ঘর গােছানাে , খাবার আয়ােজন করা ইত্যাদি কাজে অবশ্যই স্ত্রীর মতামত অগ্রগণ্য থাকবে । কারণ , এটি তার অধিকার । সে অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী । প্রধানমন্ত্রীর মতাে তারও সাধারণ ও ব্যাপক অধিকার রয়েছে । এখন যদি স্ত্রী অপরিচ্ছন্ন হয় , ঘর - দুয়ার পয়ঃপরিষ্কার করে না রাখে অথবা ভালাে রান্নাবান্না করতে না পারে তাহলে স্বামী এ ব্যাপারে তাকে সতর্ক করবে । অনেক লােক আছে , যারা ঘরের সৌন্দর্য , মেঝের চাকচিক্য ও বারান্দার পরিচ্ছন্নতার প্রতি কোনাে খেয়াল করে না । তারা চায় , স্ত্রী কেবল তাদের জীবনসঙ্গিনী হয়ে থাকবে । তাদের মতের অনুকূলে মত প্রকাশ করবে । যেখানে নিয়ে যাবে সেখানে যেতে প্রস্তুত থাকবে । কিছু কিছু মহিলাও এমন আছে , যারা নােংরা জীবন যাপন করে । এখানে ওখানে জামাকাপড় পড়ে থাকে ! বিছানাটা থাকে এলােমেলাে ! চেয়ারটা থাকে উল্টানাে ! রাতের থালাবাসন সকালেও ধােয়া হয় না ! স্বামী কিছু বললেই চিল্লিয়ে ওঠে বয়ান ছেড়ে দেয় যে , সেই সকাল থেকে কাজ করছি , কিছু দেখছ না ! আবার সাজানাে - গােছানাে খাটে বসলেও চিৎকার মেরে বলে , এইমাত্র ভাঁজ করলাম আর তুমি ওখানে বসে পড়লো । মূলত প্রকৃত জ্ঞানবান নারী সে , যে সবসময় স্বামীর সন্তুষ্টি তালাশে মগ্ন থাকে । কী করলে স্বামী খুশি হবেন , তা নিয়ে ভাবতে থাকে । ঠিক পুরুষেরও উচিত স্ত্রীর মনােরঞ্জন করা । নিজের কর্তৃত্বের ধোকায় পড়ে তার সাথে অসদ্ব্যবহার না করা । নিজেকে পারস্যসম্রাট নওশেরওয়া ভাবা ঠিক নয় ।ঐ মানুষ আদর্শ মানুষ নয় , যে কেবল আদেশ - নিষেধই চিনে । পক্ষান্তরে যা । কিছু ভালাে , তা শুধু নিজের জন্যে রাখে । প্রকৃত মানুষ তাে হলাে সে , যার ভালােটুকু থাকে পরের জন্যে আর মন্দটুকু রাখে নিজের জন্য । নিজের সুখটাকে অন্যের জন্য বিলিয়ে দিতে পারার মধ্যেই প্রকৃত ভালােবাসা নিহিত থাকে । এমন মনমানসিকতা পােষণকারীর মুখেই আসল শােভা পায় - ‘ আই লাভ ইউ '।

Post a Comment

0 Comments